প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দুই নারী জনপ্রতিনিধির ফোনালাপ ফাঁস!
অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপকে কেন্দ্র করে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় চলছে ব্যাপক তোলপাড়। বলা হচ্ছে, ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপটি উপজেলার জল্লা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার ও সাময়িক বরখাস্ত সংরক্ষিত নারী সদস্য (৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড) দিপালী হালদারের।
এ ঘটনায় তোপের মুখে পড়েছেন ওই দুই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ফোনালাপে বেবী রানী হালদার কর্মসূচি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ‘ভাগের টাকা’ দাবি করেন। পাশাপাশি, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) জন্যও ৯০ হাজার টাকা দাবি চান। বিষয়টি নজরে গেলে টনক নড়ে জেলা প্রশাসনের।
সেখানে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নামও উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে অডিও রেকর্ডিংটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার।
সূত্র জানায়, ওই কথোপকথনটি পাঁচ মাস আগে হলেও সম্প্রতি তা অনলাইনে ছড়িয়ে পরে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুরো উপজেলায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) এই প্রকল্পে উজিরপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে তিন হাজার ৫৭ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মোট ৬৬টি প্রকল্পের জন্য সরকারের ওই অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দের বেশিরভাগ টাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আত্মসাৎ করেছেন। জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্পের সভাপতি এবং ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নিজেদের পছন্দের লোককে শ্রমিক দেখিয়ে তাদের নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন। পরে প্রকল্পের ভুয়া শ্রমিকের হিসাব নম্বর থেকে টাকা উত্তোলন করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করছেন।
এ বিষয়ে সাময়িক বরখাস্ত সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মুঠো ফোনে তিনি বলেন, ‘জমি নিয়ে আমার সঙ্গে একই এলাকার স্বপন ও তপনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। তারা চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের কাছের লোক। এ কারণে অনেক আগে থেকেই চেয়ারম্যান আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন। আমি মেম্বার পদে থাকি তাও তিনি চান না। এসব কারণে অন্যদের দিয়ে বিরুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে নানা জায়গায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তাতেও তিনি ক্ষান্ত হননি।’
‘বেবী রানী হালদার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে দুর্বব্যবহারের সহ নানা অভিযোগ এনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ কারণে আমাকে কয়েক সপ্তাহ আগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’
দিপালী আরও বলেন, ‘এলাকায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্প বাস্তবায়ন বাবদ ইউএনও স্যারকে দেয়ার কথা বলে আমার কাছে ৯০ হাজার টাকা চান চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদার। এছাড়াও তার পারসেন্টেজ হিসেবে আরও টাকা চান। আমি তাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর আরও টাকার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন চেয়ারম্যান। এ ঘটনা প্রায় ৫ মাস আগে। এত টাকা কেন দেয়া লাগবে তখন ফোন করে চেয়ারম্যান বেবী রানীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। এর পরপরই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন তিনি। তার লোকজন দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে থাকেন। ওই ফোনালাপ সম্প্রতি কেউ ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহা বলেন, ‘দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। তাছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে গালাগালি ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে গত মাসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আদেশে বরখাস্ত করা হয়। তাই বরখাস্ত একজন সংরক্ষিত ইউপি সদস্য ফোনে কাকে কী বলল তার গ্রহণযোগ্যতা নেই।’
ফোনালাপের বিষয় জানতে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রানী হালদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে সংযোগ বন্ধ পাওয়া গেছে। আর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রণতি বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে মোট ১৪ বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফোনালাপটি প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফোনালাপে যাদের কণ্ঠ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তারাই কথাই বলেছেন প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারাই সম্পৃক্ত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।