বিদেশের নাগরিকত্ব বিশ্বাসঘাতকতার ছাড়পত্র নয়
সেই আদিমকাল থেকেই মানুষ যাযাবর। বিভিন্ন কারণে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এই স্বভাবটা হয়তোবা তারা জিনগতভাবেই পেয়ে এসেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় সভ্যতার অনেক উন্নতি হয়েছে। মানুষের জীবনে এসেছে অনেক মৌলিক পরিবর্তন।
মানুষের সমাজ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের কাছে নিজেকে আত্মসমপর্ণ করেছে। সমাজে তৈরি হয়েছে শ্রেণি ব্যবধান। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে জীবনযাত্রার ব্যবধান। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনে এসেছে অভাবনীয় গতি। সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষ হাঁপিয়ে উঠলেও থেমে যাবার অবকাশ নেই কারণ থেমে গেলেই অন্যের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে।
দিনে দিনে মানুষের জীবনযাত্রা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নিজের, নিজের পরিবারের, সমাজের, জেলার, দেশের বৃহত্তর অর্থে মহাদেশের স্বার্থ সবাই আগে দেখে এখন। সামগ্রিকভাবে এখন কেউ আর সমগ্র পৃথিবীর ভালো চিন্তা করেন না। হাতেগোনা যে দু’একজন এগুলো নিয়ে ভাবেন বা কথা বলেন তাদেরকে দেয়া হয় পাগল আখ্যা।
দিনে দিনে পৃথিবীর অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে গেছে যে এখন একটা দেশ তার নিজের নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা দেয়ার জন্য অন্য আরেকটা দেশের মানুষদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে পিছপা হয় না, তাই দেশে দেশে যুদ্ধ লেগেই আছে। আর বিশ্বের অস্ত্রের মজুদ এমন পরিমাণে বেড়ে গেছে যে সেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করার জন্য হলেও যুদ্ধ অবধারিত হয়ে দেখা দিয়েছে।
সেটা করতে গিয়ে বিশ্ব মানবতার কতখানি ক্ষতি হচ্ছে সেটা থোড়াই কেয়ার করছে সবাই। একটা দেশের মধ্যে যেমন সরকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছুই ধনীদের স্বার্থের সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত ঠিক তেমনি বৈশ্বিকভাবেও সব ধরনের সংগঠন ধনী দেশগুলোর স্বার্থ-সুরক্ষা দিতে গিয়ে তাদের ক্রীড়ানক হয়ে ওঠেছে।
এমতাবস্থায় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষগুলো উন্নত জীবনের আশায় দেশান্তরী হচ্ছে তবে এখানে একটা কথা বলে নেয়া জরুরি সেটা হচ্ছে এই প্রবণতা শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেই প্রকট। তারা যেহেতু জানে বিশ্বের কোন দেশে কি বাড়তি সুবিধা আছে তাই তারা সেগুলো লুফে নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।
অবশ্য অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরাও দেশান্তরি হয় তবে সেটা শুধুই জীবিকার তাগিদে। তারা জীবিকা নির্বাহ করে সমুদয় অর্থ নিজ দেশেই পাঠান।
আমার জন্ম বাংলাদেশের একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। পদ্মা নদীর চর এলাকা চরভবানীপুরে জন্ম এবং শৈশবের বেড়ে ওঠা যেখানে সভ্যতার ছোঁয়া বলতে ছিল ব্যাটারিচালিত রেডিও আর টর্চলাইট। আমাদের খেলাধুলার সকল উপকরণ আমরা প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করতাম।
নদীর পাড়ে বিভিন্ন ফসলের খেত পাহারা দেয়ার সময় নদীর অপর পাড়ের কোনো টিনের চালা রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠলে আমরা সেটা নিয়ে নান কাল্পনিক গল্পজুড়ে দিতাম। আর দেখা যেত কুষ্টিয়া শহরের ওয়ারলেস টাওয়ার। আমরা খুবই অবাক হতাম এতবড় একটা জিনিস কিভাবে বানিয়েছে সেটা ভেবে।
আর রোজার সময় আমাদের ইফাতারের রেফারেন্স ছিল কুষ্টিয়া শহরের রেনউইক কারখানার টানা হুইসেল। এই হুইসেলের শব্দ নদীর অপর পাড়ে থেকেও আমরা শুনতে পেতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল নদীর ঘাট। সেই ঘাট দিয়ে পারাপার হত নানা ধরনের মানুষ। কিছু মানুষকে দেখতাম খেয়া পার হয়ে নদীর পারে অপেক্ষারত পালকিতে চড়ে যাত্রা করছেন দূরে কোথাও। বড়রা বলতেন তারা যাচ্ছে পাবনায় ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আশ্রমে।
আমাদের গ্রামের অবস্থানটা ছিল খুবই অদ্ভুত জায়গায়। প্রশাসনিকভাবে আমাদের গ্রামটা ছিল কুষ্টিয়া সদর মৌজার অন্তর্ভুক্ত কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে যেতে দিন শেষ হয়ে যেত। কুষ্টিয়া শহর থেকে গড়াই নদী পার হওয়ার পর হরিপুর। হরিপুরের মাঝ দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর পড়ত পদ্মা নদী।
পদ্মা নদীর অপর পাড়ে ছিল আমাদের গ্রাম। পদ্মা নদী বর্ষার সময় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তখন দিনে একবার শুধুমাত্র খেয়া পার করা হয় অনেক ঝুঁকি নিয়ে। তখনও ইঞ্জিনের নৌকার চল শুরু হয়নি। দাঁড় আর পালের উপর ভরসা করে যাত্রা করতে হত।
আর বছরের অন্যান্য সময় পুরো পদ্মা নদীতে বালির চর ধুঁধুঁ করে। সেই বালির চর পায়ে হেঁটে পার হতে গিয়ে আমাদের পায়ের তলা পুড়ে পাতিলের তলার মতো কালো হয়ে যেত। অন্যদিকে সড়কপথে আমরা সহজেই পাবনায় যেতে পারতাম তাই প্রশাসনিকভাবে সকল কর্মকান্ড কুষ্টিয়া মৌজার অন্তর্ভুক্ত হলেও সব কর্মকান্ড ছিল পাবনাকেন্দ্রিক।
এমন একটা জায়গায় শৈশবের রংধনু রঙিন দিনগুলো পার করার প্রভাব পরে আমার পুরো জীবনবোধে। গ্রামের মানুষদের সরলতা এবং আতিথেয়তা আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করে। এরপর একটা সময় জীবনে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ করলাম কিন্তু সেই গ্রামীণ আবেগকে প্রাধাণ্য দিয়ে সৎ জীবন এবং জীবিকার জন্য বেসরকারি চাকরিতে যোগদান।
এরপর দেখলাম বেসরকারি চাকরি হচ্ছে গ্রামের সেই শেয়ালের গল্প। শেয়াল সুখে শান্তিতে ছিল আকাশে। জমিনে উলুর ধবধবে সাদা ফুলের খেত দেখে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন তাদের যেন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর সৃষ্টিকর্তা তাদের ইচ্ছে পূরণ করেন কিন্তু শর্ত দেন যে আর তারা আকাশে ফিরে আসতে পারবে না।
পৃথিবীতে এসে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানান তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য কিন্তু সৃষ্টিকর্তা রাজি হন না। তারপর থেকে তারা রাতের বেলায় দলবেঁধে আকাশের দিকে মুখ করে হুক্কা হুয়া ডেকে চলেছে। বেসরকারি চাকরিও অনেকটা সে রকম। জীবন থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নেবে কিন্তু সামান্য ভুল হলেই দিবে ছুড়ে ফেলে।
এটা বুঝতে বুঝতে আমার দশ বছর লেগে যায়। যখন বুঝতে পারলাম তখন আবার বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলাম অনেকটা সেই জল ঘোলা করে খাওয়ার মতো।
সরকারি চাকরি করতে গিয়ে সেই প্রথম বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের সংস্পর্শে এলাম। এর আগেই অবশ্য বেসরকারি চাকরি সূত্রে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রকৃতি অতি মনোরম। প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশকে সাজিয়েছে।
আর তার সঙ্গে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যাদের দু’বেলা অন্ন সংস্থান করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। অন্ন সংস্থান না হলেও তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। তারা বলেন সৃষ্টিকর্তা কপালে রাখেন নাই তাই পান নাই বলে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়েন।
পরের দিন এমনকি পরের বেলা কি খাবেন সেটা পর্যন্ত নিয়ে তারা ভাবেন না। আমি শুধু তাদের হাড়াভাঙা খাটুনি দেখতাম আর ভাবতাম কেন তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। তখন বুঝলাম প্রথমত তারা নিজেরা চান না আর দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাও চায় না তাদের উন্নতি হোক কারণ তাহলে দারিদ্র্য দেখিয়ে বছর বছর যে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ত্রাণ এবং ঋণ হয় সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর সেটা বন্ধ হলে ধনীদের আরো ধনী হওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
সরকারি চাকরিতে এসে এই সত্যটা আরো বেশি করে উপলব্ধি করলাম। যাইহোক দেশের কল্যাণ, দশের কল্যাণ এগুলো আসলেই এখন শুধু আভিধানিক শব্দ। আসল কথা হচ্ছে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমরা দেশের পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা আমাদেরকে পদেপদে স্বার্থপরতার এই শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য শুধু আমাদের দেশের দোষ দিয়েই বা কি হবে পৃথিবীব্যাপীই এখন এটা অপ্রিয় সত্য তবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্যটা খুবই প্রকট।
এখানে ধনীরা দিনে দিনে আরও ধনী হচ্ছে আর গরিবেরা আরও গরীব হচ্ছে। ধনী গরিবের একটা ভারসাম্য রাখার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের, কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু ধনিক শ্রেণিরা নিয়ন্ত্রণ করে তাই গরীবের সামান্যতমও স্বার্থও সেখানে প্রাধান্য পায় না। ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তাও রাষ্ট্র যন্ত্র দিতে পারছে না।
অবশ্য গরীবদের এগুলো নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই কারণ তারা জানেই না যে তারা অধিকারবঞ্চিত। তারা এটাকে তাদের নিয়তি ধরে নিয়েই বেঁচে থাকে। আর কোনো কিছু না পেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
উচ্চতর শিক্ষা আমাদের সবসময়ই নিজেদেরকে উচ্চশ্রেণির মানুষ ভাবতে শেখায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, কথাবলা বা সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনকে দেখা হয় দুর্বলতা হিসেবে। আর পাশাপাশি বাড়িয়ে দেয় উচ্চাকাঙ্খা।
এই উচ্চাকাঙ্খাটাও বহুমুখী। আরও ডিগ্রির উচ্চাকাঙ্খা, আরও উঁচু বেতনের উচ্চাকাঙ্খা, আরও নিরাপদ জীবনের উচ্চাকাঙ্খা সর্বোপরি নিজের বুড়ো বয়সের একটা তেল তেলে ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্খা। অবশ্য এর সবগুলোকে ঢাকতে আমরা বলি যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা নিরাপদ ভবিষ্যতই আমাদের লক্ষ্য।
মজার ব্যাপার হচ্ছে নিজে আমরা যে সিস্টেমে বেড়ে উঠি বড় হয়ে যাওয়ার পর রাতারাতি সেই সিস্টেমকে দূষিত আখ্যা দিতে ভুল করি না কিন্তু একটা ব্যাপার আমরা ভুলে যায় সেটা হলো যে যত বেশি প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে মানুষ হবে সে ততবেশি কষ্টসহিষ্ণু হবে এবং জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
দেশের সর্বোচ্চ সুবিধাদি ভোগ করেও আমরা কি এক অলীক অনিশ্চয়তায় ভুগি এবং আরও নিরাপদ ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় আমরা দেশান্তরিত হয়। দেশান্তরী হওয়ার পরই আমাদের দেশপ্রেম রাতারাতি শত সহস্রগুণে বেড়ে যায়।
তখন দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজনীতি সবকিছু নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে রাখি। বিষয়টা অনেকটা গ্রাম বাংলায় প্রচলিত সেই প্ৰবাদটার মতো
‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’। দেশকে আমরা যদি এতটাই ভালোবাসতাম তাহলে কেন দেশ ছাড়লাম। এটা আসলে অনেকটা দেশ ছাড়ার ক্ষততে মলম লাগানোর মতো একটা ব্যাপার।
নতুন দেশে এসে অনেকেই তাদের স্বপ্নের জীবিকা খুঁজে পায় না কিন্তু আর দেশেও ফিরে যেতে পারে না কারণ দেশে ফিরে গেলে যে পরিমাণ সমালোচনা শুনতে হবে তার চেয়ে বিদেশেই কোনো রকম একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে জীবনটা চালিয়ে নেয়ায় শ্রেয় অন্ততপক্ষে পরবর্তী প্রজন্ম একটা নিরাপদ জীবন পাবে সেই আসায় বুক বাধা।
দেশে জীবনের অর্ধেকটা পার করে বিদেশে এসে থিতু হলেও স্মৃতিরা তাড়িয়ে বেড়ায় অহর্নিশি। অবশ্য সবাই যে একইরকমভাবে অনুভব করেন সেটা বলা যাবে না। বিভিন্নজনের বিদেশে আসার প্রেক্ষিত যেমন ভিন্ন তেমনি ভাবনাও ভিন্ন।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য অবশ্য বিদেশযাত্রা মোটেও খারাপ কিছু নয় কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ভর করে পুরোপুরিভাবে বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের আয়ের ওপর।
আর বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদেশযাত্রা মোটেও খারাপ কিছু না কারণ দেশ এখন আর ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশিরা যেখানেই গেছেন সেখানেই একটা মিনি বাংলাদেশ তৈরি করে নিয়েছেন। দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশিরাও সমানতালে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তবে সেখানে শ্রমিক শ্রেণিরই প্রাধাণ্য।
শিক্ষিত উচ্চাকাঙ্খাী শ্রেণিটা দেশের টাকায় একদিকে যেমন প্রায় বিনা-পয়সায় ডিগ্রি অর্জন করেছে ঠিক তেমনি দেশের সহায় সম্পত্তিও বিক্রি করে অনেক সময় বিদেশে নিয়ে যান। অন্যদিকে শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ উপার্জন করেন সেটা সর্বোচ্চ সঞ্চয় করে দেশে পাঠানোর চেষ্টা করেন।
যাইহোক দেশ ছাড়ার পর এক একজনের অনুভুব এক একরকম। আমার ব্যক্তিগত অনুভব হচ্ছে বিদেশের সবকিছুর মধ্যেই দেশের ছায়া খুঁজে পাই। দেশের গ্রামীণ দুরন্ত শৈশবের আদলে সন্তানদের একটা শৈশব উপহার দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি যেটা হয়তোবা দেশে থাকলেও সম্ভব করতে পারতাম না।
আসলে বিদেশে আপনি যদি সৎ এবং পরিশ্রমী থাকেন তাহলে জীবনটা মোটামুটি সরলরেখার মতো মসৃণ। দেশে থাকলে এইসবের পাশাপাশি আত্মীয়তার জোর, রাজনৈতিক দাপট এমন আরো হাজারটা বিষয় মোকাবিলা করতে হতো কিন্তু এখানে সেগুলো বলতে গেলে অনুপস্থিত।
আর আমার মতো মানুষদের জন্য একটা নতুন দেশ দেখা এবং জানাও হয়ে যায়। আর অস্ট্রেলিয়ার বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এর এখানকার বহুবিধ সংস্কৃতি এবং বহুদেশের মানুষ। অস্ট্রেলিয়াতে থাকলে আসলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মানুষের দেখা পাওয়া যায়।
আমার তাই এখন পর্যন্ত বিরক্ত লাগতে শুরু করেনি হয়তোবা কখনও বিরক্ত লাগবেও না কারণ নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া তাদের সম্মন্ধে জানা আমার অন্যতম প্রিয় একটা শখ। এক একটা নতুন মানুষ আমার কাছে এক একটা নতুন বইয়ের মতো। তাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে গল্প ছড়ানো।
প্রবাস জীবনের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। নিয়মানুসারে গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্বের জন্য শপথ নিলাম আমরা পুরো পরিবার তখন বারবার আমার মাধ্যমিকের কথা মনেপড়ছিল। আমাদের হাইস্কুলের নাম জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
সেখানে টানা কয়েক বছর আমি শপথ বাক্য পাঠ করানো এবং জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর কাজটা করেছিলাম। সেই শপথের কথাগুলোও মোটামুটি একই রকম ছিল। করোনার কারণে শপথ গ্রহণের কাজটা হলো অনলাইনে। আমরা তিনজন একসাথে শপথ নেয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো আজ বেলা একটা ছয় মিনিট থেকে তোমরা অস্ট্রেলিয়ান।
তোমাদের নাগরিকত্বের সনদপত্র তোমাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে তখন তোমরা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবে। এরপর বলা হলো নাগরিক হওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য কি হবে।
আমার বারবারই মনে হচ্ছিল যে দেশটার আলোবাতাসে জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করলাম, যে দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় নিজেকে বিশ্ব দরবারের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করলাম তাদের জন্য ঠিক কতটা কি করতে পারলাম। তখন বারবারই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলার একটা সংলাপ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার হে মহান অধিপতি,
তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব’
আমিও তো ছোটবেলায় পাঠ করা শপথের কথা রাখতে পারলাম না। নিজ দেশের সঙ্গে কি আমি বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। আর নতুন নাগরিকত্বের সনদপত্র কি আসলে আমার সেই বিশ্বাসঘাতকতার সনদ?