বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, খালি পায়ে ৪৬ বছর
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ৪৬ বছর ধরে খালি পায়ে, কালো কাপড় ও জামা পরে জীবনযাপন করছেন তালতলী উপজেলার চরপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ ইসহাক আলী শরীফ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এমন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর শোক উদযাপন মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন ভালোবাসার কারণে এলাকায় তিনি মুজিব পাগল নামে পরিচিত।
উপজেলার ছোটবগী ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ ইসহাক আলী শরীফ (৯২)। ১৯৭০ সালে তিনি জাহাজ ভাঙা শ্রমিক হিসেবে পরিবার পরিজন নিয়ে চট্টগ্রামে যান। সেখানে তিনি জাহাজ ভাঙা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দরিদ্রতার কাছে তিনি হেরে যান।
পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে গিয়েও মাঝপথে ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমতলীতে আসেন। খবর পেয়ে ৩৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে তিনি সেখানে যান। কিন্তু ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু আমতলী ছেড়ে চলে যান।
অল্প সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরগুনায় আসেন। খবর পেয়ে তিনি বরগুনায় ছুটে যান। সামনাসামনি দেখা না হলেও দূর থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেন।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট চট্টগ্রামে বসে রেডিও খবরে জানতে পারেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা হত্যা করেছে। স্বাক্ষরজ্ঞানহীন ইসহাক আলী শরীফ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। স্ত্রী সন্তানকে রেখে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। ততক্ষণে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া নিয়ে সমাহিত করে।
পরে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি আর চট্টগ্রামে ফিরে যাননি। গ্রামের বাড়িতে দিন মজুরি করে দিনাতিপাত করতে থাকেন। ওই সময় থেকেই তিনি খালি পায়ে ও কালো কাপড়, কালো জামা পরে জীবনযাপন শুরু করেন।
গত ৪৬ বছর খালি পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চাননি। বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। তার শেষ জীবনে চাওয়া বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করা।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এলাকার মানুষ তাকে মুজিব পাগল নামে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছেন। দারিদ্রতা পিছু না ছাড়লেও চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। তার চার ছেলে দিন মজুরি করে বাবার ভরণপোষণ চালাচ্ছেন।
চরপাড়া গ্রামের আব্দুল হক মৃধা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যার খবর পেয়েই ইসহাক আলী শরীফ কালো লুঙ্গি, গাঁয়ে কালো জামা এবং খালি পায়ে হাঁটছেন। গত ৪৬ বছরই তিনি এ পোশাক পরিধান করে আছেন। তিনি আরও বলেন, কখনও তার সামনে শেখ সাহেবকে নিয়ে কেউ খারাপ মন্তব্য করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। এ রকম প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি ৩-৪ বার হামলারও শিকার হয়েছেন। সারা জীবন শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও জয়বাংলার স্লোগান দেওয়ার কারণে এলাকার মানুষ তাকে মুজিব পাগল বলে ডাকেন।
ইসহাক আলী শরিফ বলেন, নেতাগো ধারে মুই কিছু চাই নাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা এই জমিনে তিনি শুইয়্যা রইছেন। আর হেই জমিনে মুই জোতা পায় দিয়া হাটমু? মুই যতদিন বাইচ্চা আছি খালি পায়েই হাইট্টা যামু।
তিনি আরও বলেন, যে মাডিতে মোর নেতা শেখ মুজিব ঘুমাইয়্যা রইছে, হেই মাডিতে মুই জোতা পায় দিয়া হাটতে পারমু না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পাইয়্যা মুই পায়ের জোতা খুলছি আজইও পায় দেই নাই। ওই সোমায় থেইক্কা কালা জামা ও কাপড় পড়ি। মোর শ্যাষ ইচ্ছা মুই বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত কইর্যা প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটু দ্যাহা হরমু।
তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ছোটবগী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মু. তৌফিকউজ্জামান তনু বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে ইসহাক আলী শরীফ খালি পায়ে হাটছেন এবং কালো পোশাক পরিধান করছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এলাকায় তিনি মুজিব পাগল নামে পরিচিত।
তিনি আরও বলেন, ইসহাক শরীফ গত ৪৬ বছর খালি পায়ে হেটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি দলের কাছে কিছুই চাননি। তবে তিনি তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন বলেও জানান।